।।মুখে মাইক্রোফোন নিয়ে মঞ্চের উপরের ছবি ফেসবুকে পোস্টিয়ে কেউ কবি হয় না। ওতে
বরং রাজনৈতিক নেতা বা আবৃত্তি প্রতিযোগিতার সঞ্চালক বেশি মনে হয়। বাহারি পাঞ্জাবি
পরা ছবি ফেসবুকে পোস্টিয়েও কেউ কবি হয় না। ও-পোশাক
পরে কেউ কেউ সোনাগাছি যায়। কবিতাটা লিখুন। তারপর লুঙ্গি পরে খালিগায়ে ছবি
পোস্টালেও আপনাকে বিনয় মজুমদারের আত্মীয় বলা যাবে।।
।। আবেগ কবিতার কোনো শর্ত নয়। আবেগহীনতাও কবিতার কোনো শর্ত নয়।
ঠিক যেমন ছন্দ-অলঙ্কার কবিতার কোনো
অবশ্যপালনীয় শর্ত নয়। নজরুল ইসলামের কবিতায় আবেগের মহাবিস্ফোরণ পাবেন।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা নিষ্কম্প। ওঁদের কে বড় কবি? আমরা দুজনকেই পড়ি। আপনি যদি
কবিতা লেখেন, মনে রাখুন আপনাকে কবিতা লেখার পারমিট কেউ দ্যায়নি। আপনি কোনো শর্ত
পূরণ করে কবিতা লিখতে আসেননি। নিজের ইচ্ছেয়, নিজের
চয়েসে আপনি কবিতা লিখছেন। আপনাকে কেউ কবি করতে পারবে না, একমাত্র আপনি নিজে ছাড়া।।
।। কবিতায় স্টান্ট
জিনিসটা ঠিক কী? এটা খুব শোনা যায়,
কিন্তু বোঝা যায় না। কেউ বুঝিয়ে দেবেন? ভারতচন্দ্রর পাঠক বলত মধুসূদন দত্তর
অমিত্রাক্ষর একটা বিদেশি গিমিক ছাড়া কিছু নয়। ঈশ্বর গুপ্তের পাঠকরা বলত রবিবাবুর
কবিতায় শুধু স্টান্ট আছে, রসের গভীরতা নেই। রবিবাবুর পাঠকরা বলত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতায় স্টান্ট
আছে। সত্যেন্দ্রনাথের পাঠক বলত নজরুল ইসলামের কবিতা চমক আর গিমিকে ভরপুর। নজরুলের
পাঠকরা বলত জীবনানন্দ অর্থহীন গিমিক আর স্টান্টের কবিতা লেখেন। জীবনানন্দর পাঠক
বলত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অহেতুক যৌনতা আর নারীশরীরের চমক বা গিমিক দেখিয়ে নাম কিনতে
চান। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। আজও কেউ বলতে পারল না কবিতায় স্টান্ট বা গিমিক
ঠিক কী এবং ক্যামোন। সেটা কি বাস্টার কীটনের মতো তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে কোটটা
ঝেড়ে নিয়ে নির্বিকার হেঁটে গিয়ে প্রেমিকার হাতে গোলাপ ধরিয়ে দেওয়া? তাহলে তো সেটা
দারুণ জিনিস! একমাত্র জিনিয়াসরা পারে।।
।। কবিতা চাওয়া, কিন্তু দ্বিতীয়বার
তাড়া না দেওয়া অনেক সময় একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। কবিতা পাওয়া, কিন্তু প্রেসের দোষে সেই
কবিতা হারিয়ে ফেলে না ছাপতে পারা, একটি রাজনৈতিক ব্যাধি। প্রথমটার মোকাবিলা করতে
হয় সঙ্গে সঙ্গে, অর্থাৎ চাওয়ামাত্রই কবিতা দিয়ে। বলটা তাহলে রাজনীতিবিদের কোর্টে
ফেরত চলে যায়। দ্বিতীয়টার কোনো প্রতিষেধক নেই, একমাত্র শল্য চিকিৎসা আছে। সামনেই
কলকাতা বইমেলা। কলকাতা লিটিল ম্যাগ মেলা। এই রাজনৈতিক
খেলাগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখুন কবি।।
।। কোন জায়গায় একটু এক্স-এর
ভাষা মেশাতে হবে, কোথায় একটু ওয়াই-এর মুদ্রাদোষ ছুঁইয়ে দিতে হবে, কোথায় গদ্যটাকে
একটু কায়দামতো কোবিতা বানিয়ে নিতে হবে, কোথায় গদ্যটাকে একদম ঘেঁটে দিতে হবে, কোথায়
দু-একটা সিনেমার পরিভাষা কপি-পেস্ট করে দিতে হবে, কোথায় একটু শৌখিন নস্টালজিয়া
লাগিয়ে দিতে হবে, শুধু এই বোঝাটুকু সম্বল করে কেউ যদি নিজেকে এই সময়ের লেখক হিসেবে
মেলে ধরতে চায়, এবং কোনো সাড়াই না জাগাতে পারে, তার ভুল ভাঙিয়ে দেওয়ার দায় কার?
আমি জানি না।।
।। কোনো বৃদ্ধ যদি আপনার কবিতার ধারণা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাকে সন্দেহ করুন। সন্দেহ খাঁটি হলে তাকে জীবন থেকে বাদ দিন। নাহলে কবিতা
লেখা ছেড়ে দিন। বৃদ্ধ কাকে বলে? বৃদ্ধ হল সেই লোক যে তার নিজের ধারণা আর
বিশ্বাসগুলোকে পর্বত মনে করে, বছরের পর বছর নিজেই নিজের পর্বত দেখে মুগ্ধ হয়ে
থাকে, আর আপনাকে বানাতে চায় নিজের ব্যক্তিগত পর্বতারোহী।।
।।সময় কবিতাকে প্রাসঙ্গিক
করে না, কবিতাই সময়কে প্রাসঙ্গিকতা দ্যায়। যে সময়ের নিজস্ব কবিতা নেই, সে বড়
দরিদ্র সময়। পশ্চিমবঙ্গে এখন সেই সময় যাচ্ছে। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে অবস্থাটা
ভালো। বাংলাদেশের কবিতা পড়লে অন্তত এটুকু বোঝা যায় কবির রক্তের রং টকটকে লাল আছে,
প্রতিষ্ঠার জল মেশেনি।।
।। এ দেশে এখনও নগ্ন ছবি আঁকা অপরাধ। সেক্সকে উপজীব্য করে উপন্যাস লেখা পাপ। কিছু লোকের ক্ষমতা থাকলে বাঘিনীকেও ব্লাউজ পরিয়ে দিত। ফেসবুক থেকে বেশ কয়েকবার আমার লেখার লিঙ্ক মুছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন কিছু
লোক। ‘পর্ণমোচী’ উপন্যাস থেকে এটা শুরু হয়েছিল। ফেসবুক এটাকে প্রশ্রয় দ্যায়, এবং তাঁরা তার সুবিধা নেন। ঠিক আছে। ‘বাক্
১০৫’-এ আমি ৫টা কবিতা লিখলাম- ‘ন্যুড, এবং অন্যান্য কবিতা’ শিরোনামে। রত্নদীপা দে ঘোষ লিখে ফেললেন একগুচ্ছ কবিতা। ফেসবুকে
ওঁর প্রোফাইল পিক এবং অন্যান্য ছবি অনেকবার অনেক বাঁকা এবং তিক্ত কমেন্টের
মুখোমুখি হয়েছে। এটা ওঁর একটা ব্যক্তিগত জেহাদ।।
।। মলয়
রায়চৌধুরীকে সেদিন রাত্তিরে তাড়া দিলাম, ‘বাক্ ১০৫-এর কবিতা
কই?’ উনি উত্তর দিলেন ‘মাতালের মগজে।’ পরের দিন সকালে তিনটে কবিতা চলে এল। তিনটে
আগুন কবিতা। তানিয়া চক্রবর্তীর কবিতা পেয়ে এবং পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওকে বললাম, ‘এই
লেখাগুলো দু-হাজার লোক পড়বে।’ তানিয়া বলল, ‘দ্যাখো অনুপম-দা, কবিতা ব্যাপারটা আমার
কাছে রেচন প্রক্রিয়ার মতো। তুমি নিতে পেরেছ বলে এই লেখা সকলে নিতে পারবে, এটা আশা
করি না।’ কী সব কবির সঙ্গে দিনকাল কাটাচ্ছি আজকাল! কী দারুণ বেঁচে আছি মিত্রোঁ!!